আজ ২৫ বৈশাখ কবিগুরু’র ১৬৩তম জন্মদিন 

Adithay Kamal জাতীয়, 9 May 2024, 229 Views,
আজ ২৫ শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩ জন্মবার্ষিকী। বাংলা ও বাঙালির জন্য এক গৌরবময় দিন। এই দিনটিকে বাঙালি নাচ, গান, নাটকে আনন্দে-হরষের মধ্যে দিয়ে উদযাপন করে। ১২৬৮ সালের ২৫ শে বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুর পরিবারে। তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রপিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। এই বংশ সাহিত্তের উন্নতি সাধন ছাড়াও ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে লালিত এবং আত্মপ্রতিষ্ঠিত ব্যাবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি জনহিতকর কাজেও সাফল্য অর্জন করেন।
২৫ শে বৈশাখের শুভ লগ্নে কোলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও মা সারদাদেবীর কোল আলো করে যে শিশু জন্ম নিল সে বিশ্বের কবি আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ। শৈশবে বিভিন্ন স্কুলে তাঁকে ভর্তি করা হয় বিদ্যার্জন করার জন্য কিন্তু শিশু রবীন্দ্রনাথের কাছে চার দেওয়ালে আবদ্ধ বিদ্যালয় বা প্রথাগত শিক্ষা কোনোটাই গ্রহণ যোগ্য হয় নি। বাড়ির অনুকূল পরিবেশে এবং পিতার সান্নিধ্যে থেকেই তিনি প্রকৃত শিক্ষা লাভ করেন। তিনি প্রাচীন ভারতবর্ষের তপোবনে যে ভাবে শিক্ষাদান কার্য সম্পাদিত হত সেই আদর্শকেই জীবনে গ্রহণ করেছিলেন। পরিণত বয়সে শান্তিনিকেতনে তিনি আশ্রমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। প্রকৃতির মুক্তাঙ্গনে বসে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দিতেন। তিনি এখানে শিক্ষক নন, তিনি হলেন গুরুদেব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্দশ সন্তান। তাঁর মা সারদা দেবী সম্বন্ধে তেমন বিশেষ কিছু জানা যায়নি। রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন দার্শনিক ও কবি, মেজো ভ্রাতা সত্তেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রথম ভারতীয় আই.সি.এস ; অন্য ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ ও নাট্যকার এবং বোনদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী দেবী ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ ছিল সঙ্গীত, সাহিত্য ও নাট্যঅভিনয়ে মুখর। শুধু তাই নয়, বাইরের জগতের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ ছিল নিবিড়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে একজন কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক। নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কারক। মূলত কবি হিসেবেই তাঁর প্রতিভা বিশ্বময় স্বীকৃত। ১৯১৩ সালে তাঁকে সর্বপ্রথম একজন নন-ইউরোপিয়ান হিসেবে “গীতাঞ্জলী” কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। এশিয়ার বিদগ্ধ ও বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই পুরস্কার জয়ের গৌরব অর্জন করেন। তাঁর সাহিত্তের প্রধান ছদ্মনাম ছিল “ভানুসিংহ”।

বিশ্বমনস্ক কবি মৃত্যুর পূর্বে প্রত্যক্ষ করেছেন মানবসভ্যতার গভীর সঙ্কটকে । তথাপি তিনি মানুষের মহত্ত্বে চির আস্তাবান ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অনন্ত জীবন, মানবাত্মা ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন মহাজীবনের যতি হিসেবে। জীবন-মৃত্যু ও জগৎ-সংসার তার নিকট প্রতিভাত হয়েছে এক অখণ্ড রূপে।
রবীন্দ্রনাথ কেবল তাঁর কালের কবি নন, তিনি কালজয়ী। বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর আবির্ভাবে ছিল এক যুগান্তর।

রবীন্দ্রনাথ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তবে তাঁর সবথেকে বড় পরিচয় তিনি কবি। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় রয়েছে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। সোনারতরী, ক্ষণিকা, মানসী, পূরবী, চিত্রা, গীতালী, গীতাঞ্জলির মতো অজস্র কাব্য-কবিতা, ডাকঘর, রাজা, রক্তকরবী, বিসর্জন, মুক্তধারা প্রভৃতি অসামান্য নাট্যসম্ভার, বৌঠাকুরানীর হাট, গোরা, চতুরঙ্গ, ঘরে বাইরে প্রভৃতির মত উপন্যাস, ছুটি, সুভা, দানপ্রতিদান, পোস্টমাস্টার, দেনাপাওনা অতিথির মতো অসংখ্য ছোট গল্প যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। শিক্ষা, দর্শন, রাজনীতি, সমাজনীতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয় নিয়ে লিখেছেন একাধিক প্রবন্ধ। আর সঙ্গীত এর কোনো তুলনা করা যাবে না। রবীন্দ্রসংগীত বিশাল সমুদ্রের মতো। সংগীত রচয়িতা হিসাবে তিনি রাজাধিরাজ। প্রেম, প্রকৃতি, পূজা ঈশ্বরভাবনা সবকটি দিকেই রয়েছে অজস্র গানের ডালি।

দেশে বিদেশে বহু জায়গায় তিনি আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছেন বা ভ্রমণ করেছেন। বাইরের জগৎ থেকে কিছু বিষয় তিনি নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেছেন অসামান্য সব গীতিনাট্য, নাট্যকাব্য যেমন- বাল্মীকির প্রতিভা, চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা, চন্ডালিকা, প্রভৃতি, যেগুলি একেবারে নতুন আঙ্গিকে তিনি নিজে অভিনয় করে দেখিয়েছেন। প্রতিটি নাটক, নৃত্যনাট্যয় তিনি মানবতার চরম সত্যকে প্রকাশ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ সামান্য একজন মানুষ নন- তিনি মহামানব। তাঁর মধ্যে মানবপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, ভগবৎপ্রেম সব কিছুই এত সুন্দর ভাবে ও এমন পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পেয়েছে যা সত্যি অতি বিস্ময়কর। মানবপ্রেমিক কবি আমাদের শিখিয়েছেন মানুষকে ভালোবাসতে, ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখতে।

প্রকৃতি প্রেম তাঁর কাব্য কবিতায় এমন সুন্দরভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে যার কোনো তুলনা নেই। প্রতিটি ঋতু – গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত যেন এক একটি জীবন্ত চরিত্র। ‘এসো হে বৈশাখ’, ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি’ প্রভৃতি গানের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি ঋতুর সুন্দর বৈশিষ্ট্য যেভাবে পাই আর কোথাও সেভাবে পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথের জন্ম বৈশাখে আর মৃত্যু শ্রাবণে। গ্রীষ্মে আগমন আর বর্ষায় প্রস্থান। জন্ম ও মৃত্যুর উপর কারো হাত নেই জেনে কেন যেন মনে হয়, এই দুটি ঋতুকে রবীন্দ্রনাথ একটু আলাদা রকম ভালবেসেছিলেন। শরৎ হেমন্ত শীত বষন্তের চেয়ে গ্রীষ্ম-বর্ষার বন্দনা একটু বেশিই করেছেন।

এত বছর পরেও রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ও সৃষ্টি দারুন ভাবে আজকের সমাজে প্রাসঙ্গিক। কারণ রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ও সৃষ্টি আমাদের এই অস্থিরময় জীবনে সঠিক পথের দিশা দেখাতে পাড়ে, পাড়ে আত্মগ্লানির হাত থেকে মুক্তি দিতে। দমবন্ধকর আবহাওয়া থেকে একটু খোলা হাওয়া এনে দিতে পারে রবীন্দ্রসংগীত। ‘আলোকের এই ঝর্ণা ধারায়’ কিছুক্ষণের জন্যে হলেও মানুষ একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে।
আদিত্ব্য কামাল, সম্পাদক জনতার খবর।