এই প্রকল্পের আওতায় বিদেশ থেকে মিটার কিনে এনে সেগুলোকে টেম্পারিং করে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লিখে ৮৪ কোটি টাকা পাচার করার অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি প্রকল্পের কর্মীদের বিদেশ থেকে ট্রেনিং করানোর কথা থাকলেও তা না করিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ১৮ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে।
এছাড়া স্মার্ট মিটারকে সেবা ক্রয় খাত দেখিয়ে মুনাফার টাকা থেকে ৩৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়। অপরদিকে দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটির চেয়ে অপরটিতে বেশি দামে মিটার বিক্রি করে সরকারের ২৪ কোটি টাকা গচ্চা দেওয়া হয়। এছাড়া এলসির মাধ্যমে অর্থ পাচার, দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতিসহ বিভিন্ন খাতে দেড়শ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড (বেসিকো) নামে স্মার্ট প্রিপেইড মিটার তৈরির এক কোম্পানির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠেছে। বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম বড় কোম্পানি ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) তত্ত্বাবধানে এই কোম্পানিটি গড়ে তোলা হয়।
কোম্পানিটির নিজস্ব নিরীক্ষায় (অডিট) এ দুর্নীতি ধরা পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কেনাকাটায়ও বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দেশে সংযোজিত স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের দাম আমদানি করা একই ধরনের মিটারের চেয়ে বেশি দেখানো হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে না গিয়ে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) কেনাকাটা করা হয়েছে। এভাবে কেনাকাটার কারণে শত শত কোটি টাকা লোপাট ও পাচার হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
পাশাপাশি ভুয়া বিল-ভাউচার, স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। কর্মী নিয়োগেও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় বেসিকোর মূল কোম্পানি ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ জানানোর পাশাপাশি আদালতে মামলা করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ওজোপাডিকোর বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ‘এসব ঘটনা আমার আমলে হয়নি। তবে এ নিয়ে মামলা হয়েছে। দুদক তদন্ত করছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তদন্তের আগে আর বেশি কিছু বলতে চাচ্ছেন না বলেও তিনি জানান।
ওজোপাডিকোর নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) রতন কুমার দেবনা বলেন, বেসিকোর এই অনিয়ম-দুর্নীতি দেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় একটি কেলেঙ্কারি। এই প্রকল্পে অর্থ পাচার, দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতিসহ এমন কিছু নেই যা হয়নি। পুরো ঘটনাটি এখন বিচারাধীন।
দেশের বিদ্যুৎ খাতকে ডিজিটাল করতে ভিশন-২০২১-এর আওতায় স্মার্ট প্রিপেইড মিটার সংযোজনের উদ্যোগ নেয় সরকার। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে ব্যয় সাশ্রয় করতে দেশেই মিটার তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়। মিটার তৈরির দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি (বেসিকো)। চীনা প্রতিষ্ঠান হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার করে বেসিকো প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এতে দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানির ওজোপাডিকোর শেয়ার ৫১ শতাংশ আর চীনা কোম্পানির শেয়ার ধরা হয় ৪৯ শতাংশ। কিন্তু ধারাবাহিক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে এক বছরের মাথায় কোম্পানিটি বন্ধ করে দেয় পরিচালনা পর্ষদ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি মালিকানাধীন বেসিকোর স্মার্ট মিটার দেশে উৎপাদনের কথা থাকলেও চীন থেকে তৈরি করা (রেডিমেড) মিটার এনে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ দিয়ে বিক্রি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। আবার এসব মিটার আমদানির জন্য ব্যাংকে মিথ্যা অঙ্কের এলসি খুলে চুক্তিবহির্ভূত ও ভুয়া ডিক্লারেশনে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে কোম্পানিটি।
পরে এ নিয়ে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ অডিট হয়। এই অডিট রিপোর্টে দেখা যায়, প্রায় ৮৪ কোটি টাকা এলসির মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এমন অস্বাভাবিক লেনদেন বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটেরও নজরে আসে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক ৩৭ লাখ ডলারের দুটি এলসি বাতিল করে দেয়।
শর্ত ভঙ্গ করে মিটার আমদানি : বেসিকোর মিটার তৈরির ব্যাপারে ২০১৯ সালের ৩০ মে তৎকালীন বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ কায়কাউসের সই করা চিঠিতে বলা হয়, মিটার অবশ্যই বাংলাদেশে অ্যাসেম্বল (সংযোজন) করে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এরপর ২০২০ সালে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) অধীন যশোর এলাকায় ৬৯ হাজার ১৬০টি মিটার সরবরাহের অর্ডার পায় বেসিকো।
এর বিপরীতে ওই বছরের ৫ ও ১৪ মে দুটি এলসি খুলে ২০ লাখ ১১ হাজার ৬৬০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে চীন থেকে রেডিমেড মিটার আমদানি করা হয়। সরবরাহের সময় মিটারগুলোর ‘সার্টিফিকেট অব কান্ট্রি অব অরিজিনে’ বলা হয় ‘ম্যানুফ্যাকচার্ড ইন বাংলাদেশ’। এটি চুক্তির সরাসরি বরখেলাপ। চুক্তি অনুযায়ী ডিপিএম পদ্ধতিতে অর্ডার নিয়ে অবশ্যই বাংলাদেশে নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন করতে হবে।
ওজোপাডিকো সূত্র জানায়, উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে (ওটিএম) এসব মিটার কেনা হলে তাদের প্রায় ১৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা সাশ্রয় হতো। কারণ, তৈরি মিটার আমদানির জন্য বেসিকোকে ১০ শতাংশের জায়গায় ১৫ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক দিতে হয়েছে।
এছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে সি প্রেইট অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন দেখিয়ে ২ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। অথচ এ সংক্রান্ত কোনো শিপিং মেমো, বিল কিংবা শিপিং কোম্পানির নাম পাওয়া যায়নি। বাস্তব ক্ষেত্রে ১ লাখ ৯০ হাজার পিস মিটার আমদানির জন্য সি প্রেইট বাবদ সর্বোচ্চ ৩৭ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। সেখানে বিল করা হয়েছে আড়াই কোটি টাকার ওপর।
স্মার্ট মিটারকে সেবা ক্রয় খাত দেখিয়ে ৩৩ কোটি টাকা পাচার : ওজোপাডিকোর সঙ্গে বেসিকোর মিটার ক্রয় চুক্তিতে কোনো ধরনের সেবা খাতের কথা উল্লেখ ছিল না। কিন্তু এই প্রকল্পে শুধু একটি ব্যাংকের ৬টি এলসির মাধ্যমে ৩১ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে রয়েছে এমডিএ ও হেস সিস্টেম খাতে ১০ কোটি ৩৬ লাখ, ইনস্টলেশন টেস্টিং ফর এমডিএ ও হেস সিস্টেম খাতে ৩ কোটি ১৪ লাখ, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ও টেকনিক্যাল সাপোর্ট সার্ভিস খাতে ৫ কোটি ৫২ লাখ, বিদেশে ট্রেনিং খাতে ২ কোটি ৯৭ লাখ, ৩ বছরের ওয়ারেন্টি খাতে ৭ কোটি ২১ লাখ এবং ৩ বছরের অপারেশন সাপোর্ট খাতে ২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
জানা যায়, ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর ওই ব্যাংকের ঢাকার গুলশান শাখায় একটি এলসি খোলে বেসিকো। ওজোপাডিকোর সঙ্গে মিটার বিক্রির চুক্তিতে বিভিন্ন সেবা খাতের জন্য এই এলসি খোলা হয়। সেখানে এমডিএম ও হেস (এইচইএস) সিস্টেম সফটওয়্যার বাবদ এলসি ছিল ১০ দশমিক ৩৭ কোটি টাকার।
অথচ এর জন্য বেসিকো চুক্তি করেছিল ১ দশমিক ২০ কোটি টাকা। অতিরিক্ত ৯ দশমিক ১৭ কোটি টাকা এলসি করে বিদেশে পাচার করা হয়।
এরপর ১০ দশমিক ৩৭ কোটি টাকায় হেস সিস্টেম আমদানি দেখায় বেসিকো। ঢাকা কাস্টমস অথরিটি এক্ষেত্রে ভ্যাট বাবদ ৬ দশমিক ২০ কোটি টাকার চাহিদা ইস্যু করে। এতে মাত্র ৫৮ দশমিক ৬২ লাখ টাকার একটি হেস সিস্টেম কিনতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৩৭ কোটি টাকায়।
ওজোপাডিকোর সঙ্গে বেসিকোর চুক্তি অনুযায়ী এমডিএম/হেস সিস্টেম সরবরাহ চুক্তি অনুযায়ী হেস সিস্টেম সরবরাহ করা মানেই ইনস্টলেশন, টেস্টিং ও কমিশনিং করে মিটার সচল রাখা। অর্থাৎ, কাজটি হচ্ছে হেস সিস্টেম সার্ভারে ইনস্টল করে কনফিগার করে দেওয়া।
চুক্তিতে এ খাতে কোনো অর্থ বরাদ্দের কথা নেই। কিন্তু ওই এলসির হেস সিস্টেম টেস্টিং ও ইনস্টলিং বাবদ ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়।
অন্যদিকে এলসির প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ও টেকনিক্যাল সাপোর্ট সার্ভিস বাবদ ছিল ৫ দশমিক ৫২ কোটি টাকা। চুক্তিতে এ বাবদও কোনো অর্থ উল্লেখ নেই। এছাড়া এলসির বিদেশ প্রশিক্ষণ বাবদ ২ দশমিক ৯৭ কোটি টাকার কথা উল্লেখ করা হয়। এ খাতে চুক্তি ছিল ৪২ লাখ টাকার। বাস্তবে ওজোপাডিকোর কাউকে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানোও হয়নি।
এছাড়া মিটারের তিন বছর ওয়ারেন্টি বাবদ ৭ দশমিক ২২ কোটি টাকার এলসি ছিল, যদিও মিটার ক্রয়ের সময়ে ওয়ারেন্টির বিষয়টি উল্লেখ থাকে। তাছাড়া ৩২ লাখ টাকা চুক্তির বিপরীতে হেস সিস্টেম তিন বছরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এলসি খোলা হয় ২ দশমিক ৯৭ কোটি টাকার।
ওই এলসিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের ১৯ অক্টোরের যে চিঠিতে প্রিমিয়ার ব্যাংককে অনুমতি দিয়েছিল, তার ‘ঙ’ নম্বর শর্তে বলা ছিল, মূল্য পরিশোধের আগে সেবাপ্রাপ্তি ও এর সমর্থে গ্রাহকের প্রত্যয়ন সংরক্ষণ করতে হবে। তবে বাস্তবে তা হয়নি। এটি মানি লন্ডারিংয়ের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) সঙ্গে ২০২০ সালের ১১ জুন বেসিকোর ২০ হাজার মিটার বিক্রির চুক্তি হয়। এ চুক্তির বিভিন্ন সেবা খাত দেখতে অপর একটি ব্যাংকের খুলনা শাখা থেকে একই বছরের ২৭ নভেম্বর ৩ দশমিক ২২ কোটি টাকার এলসি খোলা হয়। ১ লাখ ৯০ হাজার মিটার বা এর যন্ত্রাংশ আমদানির পরিবহণ খরচ বাবদ বিভিন্ন সময়ে ওই ব্যাংকসহ মোট দুটি এলসি খোলে বেসিকো। সেখানে মোট টাকা ব্যয় দেখানো হয় ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। তবে ওজোপাডিকোর নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব মিটার আমদানিতে পরিবহণ বাবদ ৩৭ লাখ টাকার বেশি খরচ হতে পারে না।
দুই প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন দামে মিটার বিক্রি করে সরকারের গচ্চা ২৪ কোটি টাকা : ওজোপাডিকো ও ডিপিডিসি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) বেসিকোর কাছ থেকে মিটার কিনেছে। তবে বেসিকো প্রতিটি সিঙ্গেল ফেজ মিটার ডিপিডিসিকে ৪ হাজার ৫০০ টাকায় এবং ওজোপাডিকোকে ৫ হাজার ৮৮৯ টাকায় বিক্রি করেছে। এ খাতে প্রতিটি মিটারে বেশি দাম ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩৮৯ টাকা। ওজোপাডিকো বেসিকোর কাছ থেকে ১ লাখ ৬৬ হাজার প্রিপেইড মিটার কিনেছে। এতে সরকারের গচ্চা গেছে ২৪ কোটি টাকার বেশি অর্থ।
ওজোপাডিকোর নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসিকোর সপ্তম বোর্ড সভায় যে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছিল, এর বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। যথাযথভাবে বাজেট প্রণয়ন করলে বেসিকোর ২৩.৬ কোটি টাকা লাভ হতো। তবে তাদের লাভ দেখানো হয়েছে মাত্র ৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। বাজেটে তারা মালামাল কিনতে যথাযথ অনুমোদন নেয়নি। কারণ, তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্থ পাচার।
পিডিবির মিটার নিয়েও প্রশ্ন : জানা যায়, কোম্পানিটি বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের আওতাধীন চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা জোনের দুটি প্রকল্পেও দেশীয় লেবেল লাগানো মিটার সরবরাহ করেছে। অভিযোগ আছে, ওই মিটারগুলোর গায়ে মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা থাকলেও বাস্তবে সেগুলো ক্রয় করা হয়েছে বিদেশ থেকে। দুই প্রকল্পের বাজারমূল্য ছিল ৩৮৬ কোটি টাকা। জানা যায়, এ বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরও একটি সিন্ডিকেট কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়া এলসির মাধ্যমে পুরো টাকা পরিশোধের চেষ্টা চালাচ্ছে।
নিয়োগে অনিয়ম : নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নিয়মনীতি না মেনে নিজেদের ইচ্ছামতো কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বেসিকোতে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়নি। অনেকে মেধাতালিকা প্রস্তুতের পরীক্ষায় হাজির না হয়েও নিয়োগ পেয়েছেন। এছাড়া নিয়োগপ্রাপ্তদের নিয়েও বোর্ডের অনুমোদন নেই।
প্রশিক্ষণ না নিয়েও বিল ১৮ কোটি টাকা : নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বেসিকো বিদ্যুতের স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের মাধ্যমে গ্রাহকসেবার মানোন্নয়নের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ করিয়েছে। এতে খরচ দেখানো হয় ১৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা। কয়েকটি ঋণপত্রের (এলসি) মাধ্যমে প্রশিক্ষণদাতা প্রতিষ্ঠান চীনের হেক্সিং ইলেকট্রিক্যালকে দেওয়া হয় সেই টাকা।
কিন্তু অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে, এক ব্যক্তিও সেই প্রশিক্ষণ নেননি। শুধু তাই নয়, প্রশিক্ষণের কোনো কার্যক্রমই হয়নি সরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ও হেক্সিং ইলেকট্রিক্যালের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানিতে (বিএসইসিও)।
বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএসইসিওর কোনো জনবলের প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রমাণ না পেলেও নিরীক্ষকরা দেখতে পান, ২০১৯ সালের মে মাসে খোলা এক এলসির মাধ্যমে ১৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকার বিল করা হয় পণ্য উৎপাদনসংক্রান্ত প্রশিক্ষণের জন্য। একই এলসির আওতায় আরও প্রায় সাত লাখ টাকার বিল করা হয়।
২০২০ সালের আগস্টে খোলা অন্য এক এলসির আওতায় ৫ কোটি ৫২ লাখ টাকার বিল করা হয়। ওই মাসেই বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে আরও একটি বিল করা হয়েছে ২ কোটি ৯৭ লাখ টাকার। এ খাতেও কারও প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রমাণ পায়নি অডিট কমিটি। ওই বছরেরই নভেম্বর ও ডিসেম্বরে প্রশিক্ষণের আরও একটি বিল ২৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা হেক্সিংকে দেওয়া হয়। কিন্তু একজন ব্যক্তিও প্রশিক্ষণ নেননি।
এছাড়া কারিগরি সহযোগিতার নামে ২০২০ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা হেক্সিংকে দেওয়া হয়েছে। মিটার স্থাপনের পর তিন বছর মেয়াদি বিক্রয়োত্তর সেবার বিপরীতে হেক্সিংয়ের নামে ৭ কোটি ২২ লাখ টাকার বিল করা হয়েছে ২০২০ সালের আগস্টে। একই বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে একই খাতে ৬২ লাখ ৬৯ হাজার টাকা হেক্সিংকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সেবা দেবে বিএসইসিও। অডিট কমিটি বলছে, এভাবে বিল দেওয়া হয়েছে টাকা পাচারের উদ্দেশ্যে।
খরচ কমানোর লক্ষ্যে আমদানির পরিবর্তে দেশে বিদ্যুতের স্মার্ট প্রিপেইড মিটার সংযোজনের উদ্যোগের অংশ হিসাবে কয়েক বছর আগে আলাদা দুটি কোম্পানি করে সরকার। দুটিই চীনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে গঠন করা। এর একটি বেসিকো, অন্যটি হলো আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান রুরাল পাওয়ার কোম্পানি (আরপিসিএল) এবং চীনের স্যানজেন স্টার ইনস্ট্রুমেন্টের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ পাওয়ার ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (বিপিইএমসি)। এটি করা হয় ২০১৯ সালে।
কিন্তু খরচ সাশ্রয়ের সেই দুই কোম্পানিতে ব্যয় হয়েছে আগের চেয়ে বেশি। দুটি কোম্পানিতে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক চড়া দামে প্রিপেইড কেনাকাটার অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংস্থাটি বিদ্যুৎ সচিব বরাবর চিঠি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) নির্দেশ দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ।
দেশে বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা বর্তমানে চার কোটির বেশি। তাদের মধ্যে প্রায় ৪২ লাখ গ্রাহক প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে প্রায় ৯ লাখ স্মার্ট প্রিপেইড মিটার। বাকি সাড়ে তিন কোটির বেশি গ্রাহকের বিল পোস্টপেইড মিটারের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হচ্ছে।